কিসমিস প্রাকৃতিকভাভে মিষ্টি এবং উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন একটি খাবার তবে এরে রয়েছে ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং আয়রনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। যা আমাদের শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী। প্রিয় পাঠক, আজকের লেখাজুড়ে আমি আপনাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করবো কিসমিস কি, এর পুষ্টিগুণ, খাওয়ার উপকারিতা, অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, প্রতিদিন কি পরিমাণ খাওয়া উচিত, দাম, ভালো মানের কিসমিস চেনার উপায় ও এসম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য।
কিসমিস কি?
কুঁচকে যাওয়া হলুদ, বাদামী কিংবা বেগুনী রঙের যে মোরসেল আমাদের কাছে কিসমিস নামে পরিচিত সেগুলো আসলে রোদ অথবা খাবার ডিহাইড্রেটরে শুকানো আঙুর। অর্থাৎ শুকনো আঙুরকে কিসমিস বলা হয়। কিসমিসের ইংরেজি অর্থ হচ্ছে Raisins (রাইসিনস)। রাইসিনস ও আঙুরে পুষ্টি উপাদান প্রায় কাছাকাছি।
কিসমিস এর পুষ্টিগুণ
১০০ গ্রাম কিসমিসে রয়েছে ৩০১ ক্যালোরি, ৩.২৮ গ্রাম প্রোটিন, ০.২ গ্রাম চর্বি, ৮০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬৫.০৭ গ্রাম চিনি , ৭৪৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৬৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৪ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৩৫ মিগ্রা ম্যাগনেসিয়াম, ০.২২৬ মিগ্রা ম্যাঙ্গানিজ, ১০১ মিগ্রা ফসফরাস, ০.৯৮ মিগ্রা জিঙ্ক, ০.২২৮ মিগ্রা কপার, ০.৭ মাইক্রোগ্রাম সেলেনিয়াম, ০.১২ মিগ্রা ভিটামিন ই, ৩.২ মিগ্রা ভিটামিন সি, ৩.৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে, ৩ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি ৯, ০.৩২৩ মিগ্রা ভিটামিন বি ৬। এছাড়াও রয়েছে ১.১৪ মিগ্রা ভিটামিন বি ৩, ০.১৯১ মিগ্রা ভিটামিন বি২ এবং ০.০০৮ নিগ্রা ভিটামিন বি ১।
কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা
কালো, হ্লুদ, বাদামী কিংবা গোল্ডেন কালারের কিসমিসের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। প্রক্রিয়াজাত করার মধ্যমে বিভিন্ন ধরণের কালারে রুপান্তর করা হয়। প্রিয় পাঠক চলুন এ পর্যায়ে নিয়মিত কিসমিস খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাকঃ
দুধ ও কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা
দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি এবং প্রোটিনের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। অপরদিকে কিসমিসে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও খনিজ উপাদান। যখন আপনি দুধ ও কিসমিস একত্রে মিলিত করবেন তখন এটি একটি পুষ্টি-প্যাকড পাওয়ার হাউসে পরিনত হয়। যা প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ ,শক্তিশালী হাড় গঠন ও হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি, হজমে সহায়তা করে, দ্রুত শক্তি প্রদান এবং ওজন নিয়ন্ত্রনেও সহায়তা করে।
গর্ভাবস্থায় কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় আপনার নিয়মিত খাদ্যতালিকায় কিসমিস যোগ করা বেশ কিছু সুবিধা দিতে পারে। এতে আয়রন এবং ফোলেটের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টির উৎস, যা শিশুর বিকাশ এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এতে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
সেক্সে কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা
যদিও যৌন স্বাস্থ্য সামগ্রিক শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা, সঙ্গীর সাথে যোগাযোগ এবং লাইফস্টাইলের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। তবে কিসমিসে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আপনার যৌন জীবনের জন্য উপকারী হতে পারে। কারনে কিসমিসে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
কাঠবাদাম ও কিসমিস খাওয়ার উপকারিতা
বাদাম স্বাস্থ্যকর চর্বি, ফাইবার, প্রোটিন, ভিটামিন ই, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানে পরিপূর্ণ। যা আমাদের হার্টের স্বাস্থ্য, হাড়ের শক্তি এবং ত্বকের সজীবতা অনয়নে সহায়তা করে। বাদাম ও রাইসিনসে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে, হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ও ত্বকে প্রাণশক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করে। পাশাপাশি হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি, এনার্জি বুস্ট এবং হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
কিসমিস বানানোর উপায় কি
আমরা সাধারণত বাজার বা দোকান থেকে কিসমিস ক্রয় করে থাকি। তবে আপনি চাইলে খুব সহজেই এবং অল্প খরচে বাজারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে বাসায় বসে এটি বানাতে পারেন। প্রিয় পাঠক চলুন এ পর্যায়ে নিজে নিজে বাড়িতে কিসমিস বানানোর উপায় জেনে নেওয়া যাক।
প্রয়োজনীয় উপাদান ও উপকরণঃ আঙুর, বেকিং সীট বা ট্রে, সিলিকন বেকিং মাদুর, রৌদ্রজ্জ্বল দিন।
প্রথমে আঙুরগুলোকে বোটা বা ডলাপালা মুক্ত করে নিন এবং ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। রৌদ্রজ্জল স্থানে সিলিকন বেকিং মাদুরে আঙুরগুলো সমানভাবে ছড়িয়ে দিন। মাছি বা পোকামাকড় থেকে রক্ষা করতে নেট বা পাতলা নেটের মশারি দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন। যদিও এতে শুকাতে একটু বেশি সময় লাগবে। আঙুরগুলো এভাবে ৪-৫ দিন রোদে রেখে শুকিয়ে নিন বিশেষ করে যতক্ষণে এগুলো কুঁচকে না যায়। রাতে শিশির থেকে রক্ষা করতে রাতের বেলা ঘরে তুলে রাখুন। আঙুর শুকিয়ে গেলে তৈরি হয়ে গেল আপনার প্রিয় ও স্বাস্থ্যকর কিসমিস। পরিষ্কার শুকনা পাত্রে সংরক্ষণ করুন এবং মাঝে মাঝে রোদে শুকাতে পারেন এতে বেশি দিন ভালো থাকবে।
সংরক্ষণের নিয়ম
কিসমিস শুকিয়ে গেলে ঘরের তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করে একটি বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে দীর্ঘ কয়েকমাস স্বাদ ও গুণ ভালো থাকবে।
কিসমিস খেলে কি ওজন বাড়ে?
পরিমিত পরিমাণ কিসমিস খেলে আপনার ওজন বেড়ে যাওয়া বা মোটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে অত্যাধিক পরিমানে সেবন করলে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহনের ফলে আপনার ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা
কিসমিস ভিজিয়ে বা শুকনা খাওয়ার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। ভেজা বা শুকনো রাইসিনস একই পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। তবে এটি ভিজিয়ে খেল দ্রুত হজমে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস রোগী কি কিসমিস খেতে পারবে?
কিসমিসে প্রাকৃতিক শর্করা এবং কার্বোহাইড্রেট তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, ফলে এটি খাওয়ার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কিসমিস খেতে পারেন তবে খুবই সীমিত পরিমাণ। আর না খাওয়া আরও উত্তম।
দাম
বাংলাদেশের বাজারে ১ কেজি উন্নত মানের কিসমিসের দাম ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা। বাজারে নিম্ন মানের ও ভেজাল পন্যের ছড়াছড়ি। তাই কোন কিছু কেনার আগে যাচাই বাছাই করে ভালো মানের পন্য কেনার চেষ্টা করুন। সেক্ষেত্রে আপনি স্বনামধন্য ব্রান্ড বা বিক্রেতার নিকট থেকে প্রোডাক্ট কিনতে পারেন।
একজন মানুষের প্রতিদিন কি পরিমান কিসমিস খাওয়া উচিত?
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম কিসমিস খাওয়া যেতে পারে। আপনার খাদ্য তালিকায় থাকা অন্যান্য উপাদানগুলো বিবেচনা করে এটি কি পরিমাণ খাবেন সেটি ব্যালেন্স করে নিন।
অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আপনার যদি কোন প্রকার শারীরিক সমস্যা থাকে বা নিয়মিত কোন ঔষধ সেবন করে থাকেন তাহলে আপনার ব্যাক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আপনার নিয়মিত খাদ্য তালিকা তৈরি করে সে অনুসারে খাবার গ্রহন করা উচিত। অতিরিক্ত পরিমান কিসমিস খাওয়া আপনার জন্য উপকারের বদলে ক্ষতির কারন হতে পারে, অনেকে দাবি করেন যাদের এলারজি জনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি এলারজির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও এটি খাওয়ার ফলে মোটা হওয়া, এমনকি শ্বাসকষ্টও হতে পারে। তাই এমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে এটি এড়িয়ে চলার পরামর্শ রইলো।
সর্বশেষ
প্রিয় পাঠক, কিসমিস অত্যান্ত পুষ্টিকর একটি খাবার তবে আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কি পরিমান ক্যালোরি ও পুষ্টি উপাদান অন্তর্ভুক্ত আছে সেটি বিবেচনা করে পরিমাণ মতো খান। কোন প্রকার শারীরিক সমস্যা থাকলে বিশেষ করে ডায়াবেটিস সমস্যা থাকলে এটি খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আমাদের লেখা নিয়ে আপনার কোন প্রশ্ন কিংবা মতামতা থাকলে লিখতে পারেন আমাদের কাছে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
আরও পড়ুনঃ ওটস এর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম।
Pingback: কোয়েল পাখির ডিমের উপকারিতা, পুষ্টিগুণ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া